বাজার করার কায়দা কানুন

অনেকে  একটা কথা বলে থাকে “পেছন দিয়ে হাতি গেলেও কিছু হয়না ,সামনে দিয়ে পিপড়া গেলেই যত সমস্যা ” হ্যা অগোচরে কিছু হলে অগোচরেই থেকে যায় ,জ্ঞানত ভুলকে মেনে নেওয়া খুব কঠিন। আমরা প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয়  খাদ্যদ্রব ক্রয় করে থাকি । কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি যা কিনছি তার খুচরামূল্য কত,পাইকারী মূল্য কত, ডিলার মূল্য কত ? নিজেদের মধ্যে পার্থক্য কত ? কিভাবে এই মূল্য নির্ধারিত হয় ? খুচরা দোকানদার পণ্য ক্রয় করে পাইকারী দোকানদারের কাছথেকে ।পাইকারীদোকানদার পণ্য ক্রয় করে ডিলার বা ডিপো থেকে। ডিলার পণ্য সংগ্রহ করে কোম্পানীর ফ্যাক্টরী থেকে । কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রেও একই রকম খুচরা দোকানদার পণ্য ক্রয় করে আড়ৎ থেকে । আড়ৎ পণ্য ক্রয় করে মাঠ পর্যায়ের দালালের নিকট থেকে । দালাল পণ্য ক্রয় করে কৃষকের নিকট থেকে। যদি আপনি একজন ভোক্তা হয়ে থাকেন । তাহলে ভাবুন আপনার ক্রয়কৃত পণ্যটির দাম কতবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসঙ্গে যদি সঞ্চয়ী হয়ে থাকেন , তাহলে আপনার সঞ্চয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না তার এই একটা মূল কারন। সবকিছুই আপনাকে অতিরিক্ত দামে ক্রয় করতে হচ্ছে। আমি আপনাকে ফ্যাক্টরী বা কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করতে বলছি না,  এইটা সম্ভবও না । তবে রাস্তা বাতলে দিচ্ছি , উপকার পাবেন। 

 আজকে আমরা বাজারের সামগ্রিক আবস্থা জানার চেষ্টা করব । এর মাধ্যমে শিখব বাজার করার কায়দা কানুন,মানসম্মত পন্যচেনার কৌশল,দোকানদারের সাথে দরকষাকষির পদ্ধতি  ।
চলুন উপায় গুলো জেনে নেই

১। কোম্পানীর প্রমোশনাল অফার দেখুন

প্রতিটি কোম্পানী তার পণ্য বাজারজাত করণের জন্য বিভিন্ন সময় প্রমোশনাল অফার দিয়ে থাকে।অফার দুই ধরনের দোকানদারের অফার ,ক্রেতার অফার। দোকানদারের অফার হলো ১ ডজন কিনলে একটি ফ্রি আর ক্রেতার অফার হল মূল্য ছাড়।  টিভিতে দেখে থাকবেন,অমুক হ্যন্ডওয়াশ রিফিল প্যাক -এ ১৫ টাকা ছাড়,তমুক ডিটারজেন্ট- এ ৮ টাকা ছাড়। তখন বাজারে হ্যন্ডওয়াশ রিফিল প্যাক  কিনতে গেলে দুই ধরনের পাবেন ছাড় সহ এবং ছাড় ছারা ।মনে করুন হ্যন্ডওয়াশ এর রিফিল প্যাক এর দাম ৫৫ টাকা । টিভিতে বলছে ১৫ টাকা ছাড়। তাহলে ছাড় সহ পণ্যটি দাম দাড়ায় ৪০ টাকা । আর ছাড় সহ দোকানদারের ক্রয় মূল্য ৩০ টাকা । বিস্তারিত বলতে গেলে দাড়ায় ছাড় চলাকালীন দোকানদারের ক্রয় মূল্য ৩০ টাকা ,বিক্রি করছে ৪০ টাকায় আর ক্রেতা ৫৫ টাকার জিনিস ১৫ টাকা ছাড়ে পাচ্ছে ৪০ টাকায় । যখন ছাড় ছিলোনা তখন দোকানদারের ক্রয় মূল্য ছিলো ৪০ টাকা আর ক্রেতার ক্রয় মূল্য ছিল ৫৫ টাকা । আপনি আরো খেয়াল করবেন। রাস্তায় চলাচলের সময় বিভিন্ন কোম্পানীর গাড়ী দোকানে পণ্য সরবরাহ করছে। আপনি তাদের মার্ক করে রাখুন । যখন ছাড় আসবে তখন  ঐ কোম্পানীর প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করুন এবং বেশী করে ক্রয় করে রাখুন । ব্যাস আপনি দোকানদারের ক্রয়মূল্যে পণ্যটি ক্রয় করতে পেরেছেন ,অতিরিক্ত ছাড় ও পেলেন। আশাকরি বোঝাতে পেরেছি। 

২। আড়তে  যান কাচাঁবাজার করতে 

 আড়ৎ কাচাঁবাজারে পণ্য বিক্রি হয় দুই ভাবে  পাল্লা হিসেবে (১ পাল্লা=৫কেজি),বস্তা হিসেবে । আড়তে খেয়াল করবেন,  একটি দোকানের সামনের  অংশে অর্থাৎ ফুটপাথে কয়েকজন দোকানি মাটিতে বসে পাল্লা হিসেবে পণ্য বিক্রি করছে অন্যদিকে পেছনে একজন দোকানদার চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে আছে ।তার পিছনে  পণ্যভর্তি বস্তা সাজানো । এর অর্থ হচ্ছে পেছনে ঐ ব্যাক্তি বস্তা হিসেবে পণ্য বিক্রি করছে  আর সামনের অংশে পাল্লা হিসেবে  ঐ পণ্যই বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ১-২ টাকা বেশি দরে। কেউ বস্তা কিনছে ১-২ টাকা কম দামে । আবার কেউ পাল্লা কিনছে ১-২ টাকা বেশি দিয়ে ।  আপনার জন্য যেটা সুবিধাজনক সেটাই করুন। তবে মনে রাখবেন এখান থেকে পণ্য ক্রয় করে খুচরা দোকানদার বাজারে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। 

৩।মাছের জন্য মৎস আড়তে যান

মাছের ব্যবসা কে বলা হয় জুয়ার ব্যবসা । সত্যিকার জুয়া নয় তবে লাভ বা লস এর পরিমানটা এতদ্রুত উঠানামা করে তাই মৎস ব্যবসায়ীরা একে জুয়ার সাথেই তুলনা করে থাকেন। খোলাসা করে বলছি ,ধরুন আড়ৎদার ১০০০ টাকা কেজিতে ইলিশঁ মাছ ক্রয় করে দোকানে সাজাল বিক্রি করার জন্য ,হঠাৎ বাজারে বেশি মাছ আসার কারনে চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত মাছ আসায় দাম পড়ে ৮০০ টাকা হয়ে গেল । এর অর্থ আড়ৎদারের কেজি প্রতি লস ২০০টাকা ,অন্যদিকে ১০০০ টাকায় মাছ কেনার পর চাহিদার তুলনায় কম মাছ আসায় দাম বেড়ে ১২০০ টাকা হয়ে গেল এর অর্থ কেজিতে ২০০ টাকা লাভ। এই দাম এত দ্রুত ওঠা,নামা করে যে আগে থেকে অনুমান করা প্রায় অসম্ভব । তাই আপনি যখন ফ্রিজে মাছ ভর্তি করার কথা ভাববেন বা মাসিক মাছ ক্রয় করার কথা ভাববেন তখন পূর্ব থেকেই তারিখ ঠিক করে রাখবেন না । বাজারের দিকে নজর রাখুন যখনই মাছের বাজার পড়ে যাবে তখনই ফ্রিজ ভরে ফেলুন।  

৪। ভেজাল পণ্য ক্রয় করা হতে বিরত থাকুন

কিছু পণ্য সবসময় ভেজাল হয়ে থাকে যেমনঃসরিষার তৈল,বেসন ,আটা,জিরা গুড়া,মরিচ গুড়া,হলুদ গুড়া ইত্যাদি  । ভাবছেন এইগুলো ভেজাল হল কিভাবে ? আপনি বাজারে এক কেজি সরিষা ক্রয় করে মেশিন দিয়ে ভাঙ্গিয়ে নিন দেখবেন ৩০০ গ্রাম তৈল পেয়েছেন। এককেজি সরিষার দাম ৬০ টাকা, তাহলে ৩০০ গ্রাম তৈলের দাম ৬০ টাকা হলে,এক কেজি সরিষার তৈল এর দাম দাড়ায় প্রায় ২০০ টাকা । বাজারে এক কেজি সরিষার তৈল এর দাম ১৫০ টাকা । দোকানদার তাহলে ২০০ টাকার তৈল ১৫০টাকায় আমাদের দিচ্ছে । তাও আবার তার নিজের মুনাফা রেখে ।  বাকিটা আপনি ভাবুন ?ভাবতে অসুবিধা হলে তৈল ভাঙ্গা মেশিন মালিকের সাথে কথা বলুন । বেসন দিয়ে আমাদের অনেক খাদ্য রান্না হয় যেমন বেগুনী,আলুর চপ,ধনেয়ার চপ ইত্যাদি ইফতারীর জন্য। শুধু ভাঙ্গা বুট গুড়া করেও বেসন হয় আবার ভাঙ্গা বুট+মোসারীর ডাল+খেসারীর ডাল+আরো অনেক ধরনের বুট দিয়েও বেসন হয়। তাই এই ধরনের পণ্য সমূহ নিজেই ক্রয় করে গুড়া করে ব্যবহার করার চেষ্টা করুন।

৫।জাপানী ইলেকট্রনিক্স পণ্য ক্রয় করুন

বাসার জন্য একটি টিভি দরকার ভাবছেন কোন কোম্পানীরটা কিনবেন ? কেনার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন পণ্যটি আপনি কতদিন ব্যবহার করতে চান ? যদি উত্তর হয় যতদিন বাচব ততদিন । তাহলে জাপানী পণ্য ক্রয় করুন । জাপানী পণ্য অন্য দেশের পণ্যের চেয়ে বেশিদিন টিকবে এইটা চিরন্তনসত্য কথা । দাম অন্যপণ্যের চেয়ে ডাবল হবে ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেশি হতে পারে তবুও জাপানী পণ্য কিনুন । আপনার অনেক টাকা বাচবে । মেরামত করতে হবে না আর অনেক দিন টিকবে। ধরুন আপনার একটি টিভি প্রয়োজন , বাজারে ২ টি জাপানী কোম্পানী আছে যেমনঃ শার্প, সনি । আপনি কোন কোম্পানীর টিভি কিনবেন ? এক্ষেত্রে মানুষের জনপ্রিয়তার দিকে তাকান । খেয়াল করুন এই দুই কোম্পানীর কোন টিভিতে মানুষের আস্থা বেশি । তাহলেই বুঝে যাবেন যেটাতে জনপ্রিয়তা বেশি সেটাই কিনুন।ইন্টারনেট রিভিউ দেখতে পারেন। তবে মাথায় রাখবেন সনির টিভি ভালো তাই জনপ্রিয়তা বেশি ।আবার শার্প এর আয়রণ মেশিন টা ভালো হতে পারে। সনির আয়রনটা শার্পের তুলনায় মন্দ হতেও পারে। মানুষের রিভিউ পড়ুন । জাপানী ব্যাতিত অন্য কোম্পানী কে না বলুন।

৬।ব্র্যান্ডের জুতা  ব্যবহার করুন 

আমাদের ব্যবহারকৃত পণ্যসমূহের মধ্যে সম্ভবত অবহেলিত পণ্য জুতা । সবসময় ধুলা-বালু লেগে থাকে তাছারা টেকসই কম হয়। কিন্তু আপনি বাজারে দক্ষ হতে হলে সববিষয়ে আপনাকে জ্ঞান রাখতে হবে। জুতার পরিচিত সমস্যা হল ক্ষয় হয়ে যায়, ছিড়ে যায়,আঠা খুলে যায়,ফেটে যায়,সেলাই কেটে যায় ইত্যাদি । ব্র্যান্ডের জুতার দোকানে কম দামের জুতাও পাওয়া যায়, বেশি দামের জুতাও পাওয়া যায়।প্লাস্টিকের জুতাও পাওয়া যায়, খাটি চামড়ার জুতাও পাওয়া যায়।  সামর্থ্যের উপর নিভর করে ব্র্যান্ডের জুতা ক্রয় করুন।দাম বেশি দিতে হবে তেমনি টিকবেও দিগুন। এমনি এমনি  ব্র্যান্ড হয়নি।লক্ষ লক্ষ মানুষের আস্থা অর্জন করে তবেই আজ এই জায়গায় । বর্ষাকালের জন্য অবশ্যই প্লাস্টিকের জুতা ব্যবহার করুন ,বর্ষাকাল চলে গেলে প্যাকেট করে রেখে দিন পরবর্তি বর্ষার জন্য। আর যাদের পেশা হাটাহাটি করা যেমন রিটেইল সেলসম্যান,বাড়ী বাড়ী চিঠি বিলি করা ইত্যাদি তাদের জন্য ব্র্যান্ডের প্লাস্টিকের জুতা সর্বোত্তম। দাম কম টিকবে বহুদিন। 

আরও পড়ুন



Comments